রাত পোহালেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) সকাল ৮টা থেকে টানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন সিসিটিভির মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে এই নির্বাচন মনিটর করবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই সিটি নির্বাচনকে অনেকে নির্বাচন কমিশনের জন্য এসিড টেস্ট হিসেবে দেখছেন। কমিশনও এই নির্বাচনকে সংসদ নির্বাচনের স্টেজ রিহার্সেল মনে করছে। তারা সিটির ভোট সুষ্ঠু করে আগাম পরীক্ষা দিতে চায়। বিষয়টি বিবেচনা করে গাজীপুরসহ ৫ সিটি করপোরেশনের ভোটকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ইসি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আয়তনের দিক থেকে দেশের বৃহৎ এই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন তার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রিসাইডিং অফিসাররা নির্বাচনি সামগ্রী নিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচনি এলাকায় টহল দিতে শুরু করেছে।
নির্বাচনে মেয়র পদে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খান ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। জায়েদা খাতুন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থেকে সদস্য পদত্যাগ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। মা প্রার্থী হলেও তার নির্বাচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন ছেলে জাহাঙ্গীর।
আগামী ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির হাতে সবচেয়ে বড় ভোট হচ্ছে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। তিন দফায় এই ৫ সিটির ভোটে হবে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় হচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দ্বিতীয় দফায় আগামী ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন এবং তৃতীয় দফায় রাজশাহী ও সিলেট সিটির ভোট হবে ২১ জুন। গত ৩ এপ্রিল এই ৫ সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।
সংসদ নির্বাচনের ৬ মাস আগে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার পরিষদের এই ভোটকে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলও এই ভোটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে দাবি করেছে খোদ ইসি।
অল্প সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠেয় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের অধীনে সবচেয়ে বড় ভোটও বটে। বর্তমান কমিশন এর আগে বড় ভোট বলতে কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এছাড়া তারা ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদের কিছু ভোট এবং বিএনপির এমপিদের পদত্যাগে শূন্য হওয়া ৬টিসহ ৯টির মতো সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন করেছে। অবশ্য এর মধ্যে অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বাতিল করে ব্যাপক আলোচনায় আসে ইসি।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এই ৫ সিটির ভোটে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নেওয়ার কারণে তখন নির্বাচনগুলোর ওপর দেশবাসীর যতটা আগ্রহ ছিল, এবার ততটা দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সব ধরনের নির্বাচন শুরু থেকেই বর্জন করে আসছে। অবশ্য কিছু নির্বাচনে দল-সমর্থিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির কথা তুলে ধরে বুধবার (২৪ মে) গাজীপুরে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসনসহ সব বাহিনী মিলে সিটি নির্বাচনকে সফল করার জন্য কাজ করছে। নির্বাচন কমিশনসহ সবার একটাই চাওয়া—যেন কমিশনকে সহযোগিতা করে। সবার সহযোগিতায় আমরা যেন গাজীপুরে ‘মডেল নির্বাচন’ জাতিকে উপহার দিতে পারি। সিটি নির্বাচনে পাঁচ স্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করে গাজীপুরকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।’’
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে সুষ্ঠু, সুন্দর একটি নির্বাচন করতে চান দাবি করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে চাই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাধ্যমে যেন গাজীপুরের সিটির জনগণকে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট উপহার দিতে পারি, সেটা নিশ্চিত করবো।’
মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জনগণ আসবে, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ভোট দিয়ে যেন চলে যেতে পারে। পুরো গাজীপুরসহ সারা বিশ্বের লোকজন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, আমরা দেখিয়ে দিতে চাই।’
এর আগে গাজীপুরে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ও সংস্থাগুলো গাজীপুরের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে—এ নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু, সুন্দর, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। সমগ্র জাতি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ, যারা তাকিয়ে থাকবে আপনাদের দিকে, ভোটারদের দিকে এবং প্রার্থীদের দিকে। আমাদের দিকে কেউ তাকাবে না। জেলা প্রশাসন, পুলিশের দিকেও কেউ তাকাবে না।’
সিটি নির্বাচনকে গাজীপুরের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্টেজ রিহার্সেল বলেও মন্তব্য করেন এই কমিশনার।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘সরকার এই নির্বাচনে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন কীভাবে হয়, তা দেখিয়ে দেবো। আগামী জাতীয় নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুরোধ করবো, আপনারা আসুন, দেখুন কেমন নির্বাচন হয়।’
এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন। গত ২২ মে গাজীপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি অভিযোগ করে বলে যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনই ক্ষমতাসীন দলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন। গণসংযোগের সময় জায়েদা খাতুনের গাড়িতে একাধিকবার হামলার অভিযোগ উঠেছে। ফলে অন্য প্রার্থীদের প্রতি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।