২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাড়িতে প্রসবের কারণে কমানো যাচ্ছে না মাতৃমৃত্যু

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় বাড়িতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান রাহিমা আক্তার নামে এক প্রসূতি। প্রসববেদনা ওঠার পর গ্রামের ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের চেষ্টা করানো হয়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ পদ্ধতিতে প্রসব করাতে গিয়ে মারা যায় তার নবজাতক কন্যাও।

হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, রাহিমাকে অনেক দেরিতে হাসপাতালে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে প্রসব করানোর চেষ্টা না করে সকালেই হাসপাতালে নিয়ে আনলে হয়তো এভাবে দুটি প্রাণ অকালে ঝরে যেতো না। বিশেষজ্ঞদের মতে, অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে বাড়িতে প্রসব, প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভধারণের সময় সংক্রমণ ও অনিরাপদ গর্ভপাতই হলো মূলত মাতৃমৃত্যুর কারণ।

দেশে গত দুই দশকে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২ শতাংশ। তবে আরও কমিয়ে আনতে চায় সরকার। হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা খরচে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের সহায়তায় অনেক নরমাল ডেলিভারি করা হচ্ছে এবং সরকারিভাবে তাদের বিভিন্ন উপহারসামগ্রীও দেওয়া হচ্ছে। তারপরও অসচেতনভাবে অনেকেই বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করানোর চেষ্টা করাতে গিয়ে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

আজ ২৮ মে (রবিবার) নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২৮ মে-কে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছিল। আর সরকারের ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশে ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। বর্তমানে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ১৬৫ জন এবং বিগত ১০ বছরে প্রতি লাখে তা ৯৪ জন কমেছে।

দেশের মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, একলামশিয়া ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ, অনির্ধারিত কারণে ৮ শতাংশ, গর্ভপাত জটিলতায় ৭ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৭ শতাংশ এবং অমানসিক শ্রমে ৩ শতাংশ মৃত্যু হয়।

অবস্টেট্রিকাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, মাতৃমৃত্যুর ৩০ শতাংশই হয় প্রসব উত্তর রক্তক্ষরণ। ২৪ শতাংশ হয় গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ, বাকিগুলো গর্ভকালীন সংক্রমণ ও বিভিন্ন ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এখনও গর্ভকালীন পরিচর্যা ভালো করে নেওয়া হয় না। গর্ভাবস্থায় মায়েদের এন্টিনেটাল চেকআপ খুবই জরুরি। কিন্তু আমাদের ৪৭ ভাগ মায়েরা চারটি এন্টিনেটাল চেকআপ নেয়, বাকিগুলো নিতে যে হবে, সেটিও জানে না। একই সঙ্গে হসপিটাল ডেলিভারি বাড়াতে হবে, ডেলিভারির পরে যে কেয়ার নেওয়া হয়, সেটিও বাড়াতে হবে।

‘মাতৃমৃত্যুর প্রবণতা: ২০০০ থেকে ২০২০ সাল’ শীর্ষক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের যৌথ প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যুর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, ২০ বছরে দেশে মাতৃমৃত্যু ৭২ শতাংশ কমেছে। এরপরও প্রতিদিন সন্তান জন্মদানজনিত জটিলতায় ১০ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের হিসাবে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। দুই দশক আগে, অর্থাৎ ২০০০ সালে এই হার ছিল ৪৪১। বছরে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমছে।

মাতৃমৃত্যু হার কমাতে বাড়িতে প্রসবের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা) ডা. মো. মাহামুদুর রহমান বলেন, গত বছরে শতকরা ৫০ ভাগ ডেলিভারি হতো বাড়িতে। এখন সেটা ৩৫ শতাংশ হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাড়িতে প্রসব যেন না হয়। কারণ বাড়িতে প্রসব হলে পরবর্তী সময়ে রক্তপাতসহ বেশ কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি বাড়িতে যেন কোনও ডেলিভারি না হয়। আর এটা করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে এক লাখে মৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে পারবো।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডেলিভারি করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি আমাদের আরও বাড়াতে হবে। তাহলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমে যাবে।

সম্পর্কিত

Scroll to Top