অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই নোয়াখালী জেলায়। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপক মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ থেকে ২০১১ সালে অবসর নেন। তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র : একটি রূপরেখা’ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং এর বিশ্ববীক্ষা নিয়ে একটি জরুরি পাঠ।
এই প্রজ্ঞাবান মানুষটি উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবনভর নিয়োজিত ছিলেন উন্নয়ন গবেষণার আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের সঙ্গে। তার এই নতুন বইটি যদিও পূর্ণাঙ্গ নয়, লেখক জানিয়েছেন- তার ভবিষ্যতের বৃহৎ এক স্বপ্নের প্রারম্ভিকা বা সূচনাবিন্দু হিসাবেই গ্রন্থটিকে তিনি পাঠকের মুখোমুখি করেছেন।
বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে বলে প্রত্যয় জন্মায় যে, বাস্তবে সেখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আছে। হয়ত সফলভাবে নয়, ব্যর্থতার তিলক পরেই এই মডেল দাঁড়িয়ে আছে।
‘নর্ডিক মডেল’কে আদর্শ এবং নরওয়েকে একটি আদর্শরাষ্ট্র বিবেচনা করে লেখক দেখিয়েছেন, এসব দেশে (স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে) আয়ের বৈষম্য কম। এর মধ্যে নরওয়েতে আয়-বৈষম্য সবচেয়ে কম। এখানে রাজনীতিতে ডানপন্থি এবং বামপন্থি দুটো প্রধান দল বা জোট দেখা যায়। বামপন্থিরা ‘সামাজিক গণতন্ত্রী’ বা ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ রূপে পরিচিত হন। তবে এই মডেল স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কেন প্রযোজ্য নয় সে বিষয়টি লেখক পরে ব্যাখ্যা করেছেন।
‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ কেমন- এর স্বরূপ চেনাতে সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-বাজার অর্থনীতি- এই তিনটি বিষয়ে ধারণাসমূহ স্পষ্ট করা জরুরি।
অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের ব্যক্তিস্বার্থতাড়িত ‘অদৃশ্য-হাত’ তত্ত্বমতে, আর্থিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যেকে নিজের স্বার্থে কাজ করলে সমাজের কল্যাণ হয়। অদৃশ্য-হাত শক্তিশালী হলে বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। মার্ক্সও পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে পুঁজিবাদের কাম্য পরিণতি হিসাবে সমাজতন্ত্রের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন।
অবশ্য এসব কোনোকিছুকেই শেষবিচারে কাম্য-মডেল হিসাবে দাঁড় করানো যায়নি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক্ষেত্রে মুনাফার গন্ধ শুঁকে এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তি-উদ্যোগ এবং সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দায়- এই দুয়ের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি আদর্শ মডেল দাঁড় করানোর চিন্তাভাবনা হাজির করেছেন।
লেখক জানান, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সতীর্থ বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত মহলানবিশ তাকে এ বিষয়ে প্রভাবিত করেন। ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপকার মহলানবিশ সোভিয়েত রাশিয়ার শিল্প-বিজ্ঞানে দ্রুত অগ্রগতির মডেলকে অনুসরণ করে ‘মহলানবিশ-ফ্রেডম্যান’ মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন।
এই মডেলে দেশীয় ভারী শিল্পকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। তবে এটি অনুসরণ করে দেশের অগ্রগতি খুব কমই হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর-পর সমাজতন্ত্রকে আদর্শ ধরে ভূমি সংস্কারে এবং শিল্পের সরকারি মালিকানা প্রতিষ্ঠায় যে-মডেল অনুসরণ করা হয় সেটি বরং বেশি ফলপ্রসূ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর কারণে এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আশির দশকে বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতি এবং মুক্তবাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। নানা ধরনের বৈষম্য এ ব্যবস্থাকে নিখুঁত রাখল না। মুক্তবাজার অর্থনীতির মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ মডেলই বলতে হবে। এর জন্যই প্রয়োজন হল- ‘নব্য উদারীকরণ পরবর্তী সমাজতন্ত্র’ মডেল।
অর্থই সব নয়। মৌলিক মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয় কল্যাণকর সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উদার শাসনব্যবস্থা এবং সেইসঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা করবে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ আছে। আর এ কথা তো এখন পরীক্ষিত যে, কমিউনিজম নানা কারণে ব্যর্থ মডেল হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
বলা যায়, বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তি উদ্যোগের বিকল্প নেই। সম্পদের বৈষম্য দূর করেই যা করার করতে হবে। বাজারব্যবস্থাকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে ব্যবহার করেও জনকল্যাণমুখী একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মডেলই লেখকের কাঙ্ক্ষিত সেই উন্নয়ন মডেল। কিন্তু এর বিহিত কীভাবে হবে?
লেখক এখানে পুনরায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মডেল তুলে ধরেছেন, যেখানে আয়-বৈষম্য সবচেয়ে কম। এর কারণ এসব দেশে শক্তিশালী করব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে আয়ের বৈষম্য দূর করা গেছে।
এদিকে গণতান্ত্রিক দেশে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের মূল সূত্র সেখানেই নিহিত যেখানে রাষ্ট্রের হাতে আয় আর সম্পদ বেশি পরিমাণে থাকে। তাই গণতান্ত্রিক দেশ বামপন্থি নীতি তখনই গ্রহণ করতে পারে, যখন দেশে রাজস্ব আয়ের অনুপাত উন্নীত করা যায়। নরওয়েতে রাজস্ব আয় জিডিপির অর্ধেকের বেশি। আমাদের দেশে এই অনুপাত দশ শতাংশের কম। এদিকে শ্রীলঙ্কা জনতুষ্টিমূলক কর রেয়াত ব্যবস্থা চালু করে এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে নিজের দেশকে দেউলিয়া হওয়ার পথে নিয়ে গেছে। দেশটির রাজস্ব আয় অনুপাতের উপাত্ত অনুকূলে ছিল না। আসলে যেটা করতে হবে সেটা হল, সরকারের আয় বাড়ানো। কিন্তু কর ফাঁকির জন্য উন্নয়নশীল দেশে করআয় বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর রয়েছে কালো টাকা। এই টাকা সরকারি হিসাবের বাইরে থাকে। এর বড় অংশ জিডিপিতে থাকে কিন্তু রাজস্বে থাকে না, তাই কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাতে আরো কম দেখায়। আমাদের দেশকে উদাহরণ ধরলে পাঠকের জন্য এই অনুপাতটি ধরতে সুবিধা হবে। এখানে কর দেয় খুব কম লোকে। কালো টাকা এখানে বিপুল এবং বিশাল আকৃতির। এই আয় জিডিপিতে যেকোনো ভাবে ঢুকে আছে কিন্তু রাজস্বে নেই, তাই কর রাজস্ব জিডিপির অনুপাতও আমাদের নাজুক।
এসব কুপ্রথা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
লেখকের মতে, কর্পোরেট খাতে কর বাড়ানোর দিকে মন না দিয়ে বরং তাদের মালিকানার কিছু অংশ শেয়ারের মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। এর মাধ্যমে মুনাফার অংশ সরকারের আয় খাতে জমা হবে। নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিমস মিড এই মডেলের জনক। এই আয় ট্রাস্টের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণে ব্যয় হতে পারে। বাংলাদেশেও এই নীতি ফলপ্রসূ হতে পারে বলে লেখক অভিমত দেন। এছাড়া ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ করনীতির পরিবর্তনের ওপরও জোর দেন।