উত্তরা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত এখন শুধু পোস্টার, ব্যানার আর দেয়াল লিখন। নির্বাচন হচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের, কিন্তু বলতে গেলে জেলাজুড়ে নির্বাচনের প্রচার, কিছুটা এসে লেগেছে রাজধানীতেও।
কাল বৃহস্পতিবার সেই নির্বাচন। কিন্তু গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের বৃহস্পতি একেবারে তুঙ্গে সে কথা বলা যাচ্ছে না। তুঙ্গে থাকার কথা ছিল, কারণ বিএনপি এই নির্বাচনে নেই, নেই নৌকার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষও। গাজীপুরের সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার, ঋণখেলাপির অভিযোগে তার প্রার্থিতা বাতিল করেও নৌকা প্রার্থীর টেনশন কমানো যায়নি। জাহাঙ্গীর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং সে কারণে তাঁর মাকে সেখানে প্রার্থী করেছেন। এখন তিনি আজমত উল্লা খানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ফেসবুকে ভিডিও ভাইরালের সূত্র ধরে দল থেকে অপসারণ, তাঁর আবার ফিরে আসা এবং আবার বহিষ্কৃত হওয়া গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চর্চা এবং সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ের অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গাজীপুর জেলাকে বলা হয় দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ। কারণ, এখানে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি এবং তার একটি গৌরবময় অতীতও আছে। এই জেলায় প্রয়াত আহসান উল্লাহ মাস্টার, রহমত আলী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আখতারউজ্জামানদের মতো জাতীয় নেতা তৈরি হয়েছেন। এমন সব নামের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান এবং সিটির বড় একটি পদে তাঁর অধিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে বড় কৌতূহল আছে দলের ভিতরে বাইরে।
পাঁচ সিটি নির্বাচনকে গুরুত্ব সহকারেই দেখছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কমিশন এটিকে মডেল নির্বাচনে পরিণত করতে চান, অর্থাৎ একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই কমিশনের লক্ষ্য। রাজপথের প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে নিকট অতীতে আমরা বেশ কিছু নির্বাচনে আমরা দেখেছি ভোটারদের আগ্রহ কম, ভোটারের উপস্থিতি সন্তোষজনক হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে গাজীপুরে ভোটারদের উৎসাহ থাকবে।
মানুষ ভোট দিতে আসবে এবং ভোটটা দিতে পারবে, এই একটা বিষয় নিশ্চিত করাটাই নির্বাচন কমিশনের বড় কাজ। সেটা হলে দলীয় প্রতীক নিয়েও বড় চ্যালেঞ্জে পড়বেন আজমত উল্লা। নৌকা শিবিরে যে কিছুটা নার্ভাসনেস কাজ করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে মাঠে। গণসংযোগের সময় জায়েদা খাতুনের গাড়িতে একাধিকবার হামলার অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার জায়েদা খাতুন বলেছেন, যতই মারামারি করুক, তিনি মাঠ ছাড়বেন না। অন্যদিকে, আজমত উল্লার প্রায় সব বক্তৃতাতেই আছে জাহাঙ্গীর আলমের প্রতি বিষোদগার। বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি জায়েদা খাতুনকেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে কথাগুলো বলছেন।
গাজীপুর সিটিতে আগে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই রকিবউদ্দীন কমিশনের অধীনে। সেই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এম এ মান্নান বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান ছিল এক লাখেরও বেশি। গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের একটি বড় ঘাঁটি বলে প্রচার করা হলেও এরকম ভোটের ফলাফলের কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দলের ভেতর হয়েছে বলে জানা নেই। দ্বিতীয়টি হয়েছে ২০১৮ সালের ২৬ জুন হুদা কমিশনের তত্ত্বাবধানে, যেটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে তিনি হারিয়েছিলেন ব্যাপক ব্যবধানে।
তাই আইনি মারপ্যাঁচে প্রার্থিতা বাতিল হলেও নির্বাচনি মাঠে জাহাঙ্গীরই ফ্যাক্টর। তিনি তাঁর মায়ের টেবিলঘড়ির পক্ষে ভোট চেয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও স্থানীয়ভাবে দলের কাঠামোর ভেতরে তাঁর শক্ত অবস্থান। মেয়র পদে নির্বাচন না করলেও কাউন্সিলর পদে বিএনপি ৩০ জনের মতো প্রার্থী আছেন। স্থানীয়রা বলছেন, মেয়র পদে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে বিএনপির ভোট। বিএনপি ঘরানার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হাতি প্রতীকের শাহনুর ইসলাম রনি ভালো ভোট কাটবেন বলে ধারণা। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর এম এম নিয়াজউদ্দিনও চাচ্ছেন সেই ভোট ব্যাংকে আঘাত হানতে। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যালটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলেই কেবল প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয় বলে একটা ধারণা আছে। তা না হলে নির্বাচন হবে অনেকটা একতরফা। বিএনপি মেয়র প্রার্থী না থাকলেও গাজীপুরের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
সবাই চায় একটি ভালো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নিক। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেটি আরও প্রত্যাশিত। ভোটদাতাদের নিজস্ব বিবেচনা আছে। কোন নির্বাচনে কী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়, তারা সেটা জানেন। সিটি করপোরেশন নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান নয়, এর কাজ সেবা পরিষেবা দেওয়া। উন্নয়নের বেদনায় গাজীপুরবাসী অনেক ভুগেছেন। নির্বাচন মানে রাজনীতি, তবে সবকিছুর পরও এই নির্বাচনে মানুষের অন্য ভাবনা আছে। শহরটা কী আসলেই শহর? বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায় কেন? ফুটপাত নেই কেন? যেগুলো আছে সেগুলো আর হাঁটবার উপযুক্ত নেই কেন? জঞ্জাল সাফ হবে কবে? পানীয় জলের গুণগত মান কী বাড়বে? নির্বাচনে মানুষ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবেন। উত্তর কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনে। আর গাজীপুরে যদি একটি ভালো নির্বাচন হয়, তবে তা পথ দেখাবে আগামীতে হতে যাওয়া সব নির্বাচনকে।