‘আপা শুনেন, আমাগো সঙ্গে সব সময়ই জাহাঙ্গীর মেয়ররে পাইছি। এলাকায় কোনও রাস্তা ছিল না, এখন দেখেন কত রাস্তা। জমির দাম আগে ১ লাখ টাকাও ছিল না, এখন ৩/৪ লাখ। সাহায্য চাইলেই মেয়রের কাছ থেকে পাওয়া যায়। আমরা তো আর অন্য কারও কাছে যাইতে পারুম না। উনি জিতলেই আমরা ভালো থাকুম…’, গাজীপুর মেয়র নির্বাচনের দিন সকাল-সকাল ক্যামেরার বাইরে দাঁড়িয়ে জনগণের কথা শুনছিলাম যখন, বেশিরভাগ ভোটারের বক্তব্য ছিল এমনই।
তারা একদমই কাজ করা অবস্থায় জাহাঙ্গীর আলমকে পেয়েছেন। দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ছোঁয়াই যে গাজীপুরে লেগেছে, যার কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের, সেটা সাধারণ মানুষের মাথাতেই নেই। তারা মনেই করে, এই উন্নয়ন হয়েছে সাবেক মেয়রের জন্যই। অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ’র সঙ্গে তাদের দূরত্ব ছিল। টঙ্গীর সাবেক পৌর মেয়র আজমত উল্লাহ’র সঙ্গে সেই দূরত্ব আসলে ‘মার্কা’ ঘোচাতো পারেনি। তাকে ঠিক আপনজন মনে করতে পারেনি গাজীপুরবাসি। সকাল থেকেই মানুষের যে ঢল, সেই ঢল ছিল জাহাঙ্গীরের পক্ষে।
আওয়ামী লীগ-বিরোধী এক জোয়ার বইছে দেশে। সেই আলাপ কিছুটা হলেও ভুল প্রমাণিত হয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থী— দুই প্রার্থীকেই মানুষ প্রাণ ভরে ভোট দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি না এলেও বিএনপির ঘরের ছেলে দাবি করা সরকার শাহনুর ইসলাম ছিলেন নির্বাচনে। বিএনপি একবারের জন্যও বলেনি শাহনুর তাদের ছেলে নয়। তারপরও ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন শাহনুর। তার বাইরে ছিল জাতীয় পার্টিসহ আরও ৪ জন প্রার্থী। আওয়ামী লীগের এই দুই প্রার্থীর ধারে-কাছেও তারা নিজেদের জনসমর্থন আনতে পারেননি। আওয়ামীবিরোধী মনোভাব বা ক্ষোভ থাকলে গাজীপুরের গণজোয়ার যে কাউকেই জিতিয়ে আনতে পারতো।
জাহাঙ্গীর যে কেবল রাজনৈতিক চালে জয়ী হয়েছেন তা নয়। সরকার আর দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয় কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তাও তিনি দেখালেন। তিনি বড় রাজনীতিবিদদের যেমন হাতে রাখার কৌশল জানেন, তেমনই একদম সবচেয়ে ছোটো যে কর্মী, যে তাকে চা এনে দেয় বা চেয়ার এগিয়ে দেয়, তাকে নিজের দলে রাখার কৌশলও তিনি জানেন। তার প্রতি সমর্থন রাখা একজন মানুষও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি ভোটের দিন। বরং অন্য শিবিরের লোক স্বেচ্ছায় তার শিবিরে চলে গেছেন ভয়-ডর তুচ্ছ করেই। কেন? কারণ, জাহাঙ্গীর আলম মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন কী, তা টের পান। সবাইকে তিনি সহায়তা করেছেন সব সময়। তার কাছে গেলে টাকা ছাড়া ফিরেছে এমন মানুষ নেই। সেই তালিকায় রাজনীতিবিদরা যেমন ছিলেন। ছিলেন সব পেশার মানুষ, এমনকি মিডিয়া-কর্মীরাও। সবার সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক রেখেছেন। সবাইকে হাতে রেখেছেন নানা ফরমেটে, যার যা প্রয়োজন তাই দিয়ে। ফলে কেউই তার হার চাননি। সবাই বুঝেছেন, জাহাঙ্গীর আলম জিতলে তারই লাভ। একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে লাভ। এখনকার জনপ্রতিনিধিরা দু’হাতে টাকা আয় করেন, কিন্তু দেন তারা খুব কমই। সাবেক এই মেয়র দু’হাতে সবাইকে বিলিয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে না, এটি তিনি করেছেন সব সময়।
গাজীপুর নির্বাচনে আমার কাছে ভিন্ন এক জিনিস মনে হয়েছে। যাদের পাশে পাওয়া যায়, তাদের সঙ্গে জনগণ থাকে। যার মাধ্যমে দেশের মতো বৃহৎ স্বার্থের বাইরে একেবারে ক্ষুদ্র স্বার্থে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাকেই তারা ভালোবাসে।
জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সঙ্গে মেলামেশা করেন খুব কমই। একবার জয়ী হওয়ার পর তাদের টিকি না পাওয়া— এই দেশের মানুষের মূল অভিযোগ। সেই অভিযোগ ছিল না জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। তিনি দুর্নীতিবাজ— এই ‘অস্ত্র’ গাজীপুরবাসীকে কাবু করেনি একেবারেই।
বড় বড় অবকাঠামো বা উন্নয়ন স্থানীয় জনগণকে স্পর্শ করে কম। তারা দেখে তার আশেপাশের অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে কিনা। সে ব্যক্তিগতভাবে ভালো আছে কিনা। যেসব প্রার্থী মনে করেন— দলের মনোননয়ন পাওয়া মানেই জিতে যাওয়া, গাজীপুর ইলেকশন তাদের নতুন করে ভাবনার খোরাক দেবে। নিজ এলাকার মানুষকে কতটা আপন করতে পেরেছে কে, সুষ্ঠু নির্বাচনে সেই জিতবে। গাজীপুর ইলেকশনে মনে হয়েছে— মানুষ এখন দল নয়, মার্কা নয়… খোঁজে একজন নেতা।