সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে পুলিশের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। দেশে উৎপাদিত ওষুধের একটি বড় অংশের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এখতিয়ার না থাকায় যৌক্তিক মূল্যের বাধ্যবাধকতা আরোপ ও যথাযথ তদারকির অভাবে ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওষুধের কাঁচামাল, বিভিন্ন চিকিৎসা উপকরণ ও ওষুধ আমদানি কমে যাওয়ায় গত এক বছরে দেশে ওষুধের মূল্য প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গত এক বছরে চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্যও দ্বিগুণ থেকে চার গুণ বেড়েছে। অনতিবিলম্বে অতিপ্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম সই করা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে সকল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সব ওষুধের দাম বৃদ্ধির সময় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে মূল্য সনদ নিতে হয়। কিন্তু অধিদফতর অল্প কিছু জেনেরিকের ওষুধের মূল্য নির্ধারণে নিজেদের পূর্ণ মতামত দিতে পারে। অন্য জেনেরিকের ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণে অধিদফতরের আওতায় আনাটা আসলে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বিষয়। এক্ষেত্রে অধিদফতরের লোকবলও বাড়াতে হবে। কারণ প্রতিটি ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একাধিক কমিটির মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হবে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওষুধের কাঁচামালের আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বাড়ে। এছাড়া কোম্পানি ভেদেও দামের তারতম্য রয়েছে। আমরা অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নিয়ে থাকি।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে ১১৭টি জেনেরিকের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার প্রদান করা হয়। তবে দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার জেনেরিকের ২৭ হাজারেরও বেশি ওষুধ তৈরি হয়। ১১৭টি ছাড়া বাকি সকল উৎপাদিত ওষুধের মূল্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে। তারা শুধু দামের বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে অবহিত করে। ফলে দেশে উৎপাদিত ওষুধের একটি বৃহৎ অংশের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এখতিয়ার না থাকায় যৌক্তিক মূল্যের বাধ্যবাধকতা আরোপ ও যথাযথ তদারকির অভাবে ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওষুধের মোড়কীকরণ সামগ্রী, পরিবহন ও বিপণন ব্যয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য, ডলারের বিনিময়ে মূল্য ইত্যাদি বৃদ্ধির কারণে সার্বিকভাবে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির সাথে ওষুধের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ওষুধের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা গ্রহণ দুরূহ হয়ে পড়েছে।