সাবাহ আফরিন তার দেড় বছরের সন্তানকে খাবার খাওয়ান স্মার্টফোনে বিভিন্ন ভিডিও দেখিয়ে। বেসরকারি চাকরিজীবী সাবাহ জানালেন, ব্যস্ততার কারণেই বাধ্য হয়ে মোবাইল ফোন দেখিয়ে সন্তানকে খাওয়াতে হচ্ছে। এতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই ছেলে খেয়ে নেয় ঝটপট, সময় বাঁচে। আবার অন্য গল্প শোনালেন গাজীপুরের বাসিন্দা রোকেয়া। এই গৃহিণী জানান, সাহায্যকারীর অভাবে ৮ মাসের সন্তানকে মোবাইল ফোন দিয়ে বসিয়ে রাখার অভ্যাস করতে হয়েছিল। এখন দুই বছরে এসে স্ক্রিনের প্রতি ভয়াবহ আসক্ত হয়ে পড়েছে শিশু। খাওয়ার সময় ফোন দিতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে এখন।
রোকেয়ার ভাষ্য, মোবাইল দেখে খেতে শুরু করলে দিন পার হয়ে যায় প্রায়ই। কারণ শিশু খাবার মুখে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে স্মার্টফোনে গান ও ভিডিও দেখে। কোনোদিন মোবাইল ফোন ছাড়া খাবার খাওয়ানো গেলে সেদিন খুব দ্রুতই সে খেয়ে নেয়। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে স্মার্টফোন দিয়েই খাওয়াতে হচ্ছে এখন।
স্মার্টফোনের এই যুগে অনেক শিশুই আসক্ত স্ক্রিনের প্রতি। এতে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর মানসিক বিকাশ। এছাড়া মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন শিশুর মস্তিষ্কের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি গ্যাজেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের চোখ। এসব জটিলতা এড়াতে চাইলে শিশুর হাতে স্মার্টফোন নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়ার বিষয়ে অভিভাবককে থাকতে হবে সচেতন। শিশুর স্ক্রিন টাইম নির্দিষ্ট করে দেওয়াও ভীষণ জরুরি।
শিশুকে কতক্ষণ দেবেন ‘স্ক্রিন টাইম?’
গ্রুমিং ফ্রিক্সের সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সামিয়া আলম বলেন, ‘আজকাল শিশুদের মোবাইল ফোন খুব অল্প বয়সেই দিতে হচ্ছে। করোনার সময় লকডাউন থেকে এটা শুরু হয়েছে। অনলাইনে ক্লাস বা স্টাডির জন্য তখন শিশুর প্রয়োজন ছিল ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনের। স্মার্টফোন যদি পড়াশোনা বা ক্লাসের জন্য দিতে হয়, তাহলে তো কিছু করার নেই। তবে ক্লাস শেষে বা পড়াশোনা শেষে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা ট্যাব বাবা-মা অবশ্যই নিজের কাছে নিয়ে নেবেন।’
শিশু কিন্তু ভিডিও দেখে অনেক কিছু শেখেও। যেমন ছড়া, গান, গুণতে শেখা, অক্ষর চেনা, ফলের নাম বা রঙ চেনা। ফলে দিনে কিছুক্ষণ শিশুকে বিনোদনের জন্য স্ক্রিন টাইম দেওয়া যেতেই পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে সেটা যেন ধীরে ধীরে আসক্তির পর্যায়ে চলে না যায়। সামিয়া আলম জানান, দিনে ১ ঘণ্টার জন্য শিশুকে স্ক্রিন টাইম দেওয়া যায়, তবে সেটা একটানা নয়। ২০ মিনিটের বেশি একটানা শিশু স্ক্রিনের সামনে থাকবে না। দিনে তিনটি সময় ভাগ করে ২০ মিনিট করে শিশুকে দিতে পারেন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ কিংবা ট্যাব। তবে ভিডিও বা কার্টুন দেখিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস করবেন না। স্মার্টফোন, ট্যাব বা টিভির সামনে বসিয়ে শিশুকে খাওয়ানো কখনোই ভালো কোনও প্র্যাকটিস না।
স্ক্রিন টাইম দেওয়া আর শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া কিন্তু এক নয়!
সন্তানকে স্ক্রিন টাইম দেওয়া মানে কিন্তু নিশ্চিন্তে তার হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া নয়! অনেক বাবা-মা সন্তানের স্ক্রিন আসক্তিকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে উল্টো তাদের জন্য নিজস্ব ফোন কিংবা ল্যাপটপের ব্যবস্থা করে দেন। এটা করা যাবে না কোনোভাবেই। শিশুর নিজস্ব ফোন কিংবা একান্তে দেখার জন্য ল্যাপটপ নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত থাকবে না। শিশু বাবা মায়ের ফোন কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহার করবে পড়াশোনা অথবা বিনোদনের জন্য। শিশু স্মার্টফোনে কী দেখছে সেটা অবশ্যই জানতে হবে বাবা-মাকে। কিছু অ্যাপসে চাইল্ড লক অপশন আছে। সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে। অ্যাডাল্ড কন্টেন্ট যেন না আসে শিশুর সামনে। ভিডিও দেখতে চাইলে ছোটদের ইউটিউব দেখতে দিন শিশুকে। শিশু যতক্ষণ স্ক্রিন দেখবে, ততক্ষণ অভিভাবকরা তার সঙ্গে স্ক্রিনে দেখা যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পচ্ছলে কথা বলবেন।